পাশ্চাত্যের জ্ঞানের গৌরবময় ইতিহাস
একটি ছোট গল্প বলবো এখন। একটা ছোট্ট কিন্তু এর প্রেক্ষাপট সুবিশাল সময়কে নিয়ে। হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসকে একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করবে আমার এই লেখাটি।গল্পটি পাশ্চাত্যের ইতিহাসের, তাদের টানাপোড়েন এবং উত্থান-পতনের।
পাশ্চাত্য সভ্যতার শুরুর দিকে লোকেরা যখন নিজেদের অস্তিত্ব, আশেপাশের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে ভাবতে লাগল, যেমন বৃষ্টি কেন হয়, ফসল কিভাবে ফলে ইত্যাদি, তারা সেসবের ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলো। বর্তমানের বিজ্ঞান জন্মলাভ করে নি তখনো। লোকেরা যতটুকু ভাবতে পারত যতটুকু চিন্তাধারা করতে পারত তাই দিয়ে সাজালো সেসব ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা। সেসব দেখাতে বলা হয় মিথ।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার বিভিন্ন myth প্রচলিত ছিল। এরপর কিছু মহান মানুষের জন্ম হলো যাদের চিন্তাভাবনা অন্য আর পাঁচজনের থেকে কিছুটা আলাদা। এরকম মানুষের সংখ্যা কম। এখনো আমরা সমাজে হঠাৎ এক-দুইজন মানুষ পাই যারা প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে ভাবতে পারে আর তারাই নিয়ে আসতে পারে নতুন দিগন্ত। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে অর্থাৎ লম্বা সময় ধরে এরকম মানুষ জন্ম নেয় যারা মিথ থেকে সরে এসে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর বিজ্ঞানসম্মত (যদিও তখনও বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি, তবে বর্তমান বিজ্ঞানের নির্যাস সেটি প্রথম দেখা যায় তাদের মধ্যে) ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন। তারা আমাদের অস্তিত্বের উৎস খুঁজতে থাকেন।
তাদের কেউ মনে করেন পানি হল সকল সৃষ্টি র উৎস, কেউবা আবার ভাবেন বায়ু, মাটি এবং আগুন সকল কিছুর উৎস। কিভাবে একটি বস্তু ওপর বস্তুতে পরিণত হয় এ সকল ব্যাখ্যা ও বিতর্ক দাঁড় করান তারা। তাদের মধ্যে বলা হয় সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মত ধারণা প্রদান করেন ডেমোক্রিটাস, যাকে এখন রসায়ন বইয়ের প্রথম পাতায়ই পড়তে হয় তার অণু আবিষ্কারের মত অনবদ্য অবদানের জন্য।
এরপর আরও সময় অতিবাহিত হয়। পাশ্চাত্যের ইতিহাসে আসেন সক্রেটিস-প্লেটোর মত মহান দার্শনিক। সক্রেটিস, যিনি ঘোষণা করেন তিনিই জ্ঞানী যিনি জানেন যে তিনি আসলে কিছুই জানেন না- নতুন ধরনের আলোড়ন তৈরি করেন পাশ্চাত্যের জ্ঞানকাণ্ডে। সক্রেটিসকে মৃত্যুবরণ করতে হয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি হিসেবে। তারই শিষ্য প্লেটো তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান করেছেন। সক্রেটিস-প্লেটো উভয়ই সার্বজনীন জ্ঞানের কথা বলে গেছেন।
প্লেটোর মতে মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত ছাঁচ থাকে যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। পরবর্তীতে প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল পাশ্চাত্য জ্ঞানকাণ্ডে জীববিজ্ঞানের নতুন সংযোজন ঘটান। এবং বিভিন্ন জ্ঞানের চর্চা করেন তার তৈরি ‘একাডেমিয়া’ তে।
সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের সমসাময়িক যুগকে স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। কেননা তখন এথেন্স তথা সামগ্রিক গ্রিসই জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি ও অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে উন্নতির শীর্ষে ছিল।
কিন্তু রাজা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রীক সাম্রাজ্য পতনের শুরু হয়। উল্লেখ্য, সক্রেটিসের সমকালের আরেকদল দার্শনিক ছিলেন যারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন এবং গ্রিসে এসে তাদের শিক্ষা বিতরণ করতেন। তাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু ছিল মূলত জীবন উপযোগী দক্ষতা এবং সামাজিক কার্যকারিতা।
গ্রিক সাম্রাজ্যের পতনের সমকালীন সময়ে উত্থান হয় রোমান সাম্রাজ্যের। এই দুই সাম্রাজ্যের জ্ঞানকান্ডের সেতু বন্ধন হিসেবে দেখা হয় Stoicism কে। এর মূল বক্তব্য এই যে মানুষের মন পরিপূর্ণ শূন্য অবস্থায় (tabula rasa) থাকে এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেটি ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়।
রোমে তখন এরই মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক শৃংখলার ধারনা উন্নতি সাধন করতে থাকে। আবার একই সময়ে রোমে বিভিন্ন লেখকরা মানবিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়-আশয় তুলে আনতে শুরু করেন যেটি খ্রিস্টধর্মের প্রসারে সহযোগিতা করে।
রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সমাজে অনেকগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রাজা কনস্টানটিন এর আমলে খ্রিস্টান ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে বিজয়ী হয়। তখন থেকে চার্চভিত্তিক সনাতন খ্রিস্টান ধর্ম চালু হয় এবং বিশপ সেন্ট অগাস্টিনের প্রবর্তিত ধারায় তখন সকল প্রকার বিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করা হয়, সমাজবিজ্ঞানীদের কে নাস্তিক আখ্যা দেয়া হয়। এরই মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য প্রবেশ করে অন্ধকার মধ্যযুগে। মধ্যযুগের সকল প্রকার শিল্প-সাহিত্যও নিষিদ্ধ করা হয়।
এই অবস্থার অবসান হয় যখন পাশ্চাত্য সমাজ প্রাচ্যের, বিশেষত, ক্রমবর্ধমান ইসলামিক শক্তির সম্মুখীন হয়। তখনকার সময়ে ইসলামিক সাম্রাজ্যগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা ও প্রসার দেখা যায়। তারা পাশ্চাত্যের নিষিদ্ধকৃত সক্রেটিস-প্লেটোনিক পুস্তক সংগ্রহ করে সেসকল জ্ঞানের চর্চা ও প্রসার সাধন করতে থাকে।
এমতাবস্থায় পাশ্চাত্যে পুনরায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তখনকার সময়ে বিশপ থমাস আকুইনাস ছ্রিশ্চিয়ানিটিতে নতুন এবং অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ধারার প্রবর্তন করেন যার মতে মানুষের উচিত ঈশ্বরকে এবং প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করা (যেটি অগাস্টইনিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি তে নিষিদ্ধ ছিল যেখানে ঈশ্বরকে রহস্যাবৃত করে রাখা হয়েছিল)।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়, শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে, সংঘটিত হয় রেনেসাঁ। বিখ্যাত রেনেসাঁ শিল্পীর মধ্যে অন্যতম হলেন লিওনার্দ দ্যা ভিঞ্চি। এছাড়াও আলবেরখ্ট দুরার, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, থমাস ম্যুর – এরাও রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক।
রেনেসাঁ পরবর্তীতে পাশ্চাত্য সমাজে যে টানাপোড়েন তৈরি হয় তা হল বিভিন্ন ধরনের মানুষের পরস্পরের সংস্পর্শে আসা। বিভিন্ন রকম সমুদ্র অভিযানের মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গা আবিষ্কার করতে থাকে যা তাদের কাছে একেবারেই নতুন। ফলে বিভিন্ন রকম মানুষের সম্মুখীন হয় তারা, যারা তাদের থেকে এতটাই ভিন্ন যে তারা আদৌ মানুষ কিনা – এটিই পশ্চিমাদের কাছে তখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। জন্ম হয় ‘অন্যতা’-র। যার জন্ম প্রবাহ চলমান এখনো।
ফিরে আসা যাক পশ্চিমা সমাজে। ইউরোপে তখন বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়, যেটিকে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তখন এটি আবিষ্কৃত হয় যে সূর্য পৃথিবীকে নয়, বরং পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিউটনিয়ান বিজ্ঞান তখন চালু হয়। নিউটনের দর্শন কে বলা হয় মেকানিক্যাল দর্শন।
সাইন্টিফিক রিভলিউশন এর হাওয়া লাগে সোশল সাইন্সেও এবং সংগঠিত হয় এনলাইটেন্মেন্ট (আলোকময়তা)। এনলাইটেন্মেন্ট (enlightenment) এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানুষের যৌক্তিকতা, উন্নতি এবং সর্বোপরি যথার্থতা (perfectibility)।
পরবর্তীতে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ফরাসি বিপ্লব যেটি ১৭৮৯-তে শুরু হয়ে প্রায় এক দশক পর্যন্ত বিরাজ করে। এ বিপ্লব সংঘটিত হয় এনলাইটেনমেন্টের আদর্শের উপর ভিত্তি করে। বিপ্লব যখন চরমরুপে প্রকাশ লাভ করে এবং সমাজে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, বুদ্ধিজীবীরা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।
ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রক্ষণশীল মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যেমন ইভানজেলিক্যালবাদ, যেখানে নিউটনিয়ান কারিগরের ধারণা লুপ্ত হয়ে ঈশ্বর হয়ে ওঠেন শাস্তিপ্রদানকারী এবং এটি সমাজবিজ্ঞানকে অতিমাত্রায় বস্তুবাদী, নাস্তিক্যবাদী এবং অনৈতিক হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
এটি ছাড়াও জাতীয়তাবাদ, রোমান্টিসিজম ইত্যাদি তখন প্রচলিত ছিল। তখনই জন্ম হয় পজিটিভিজমের, যেটি প্রদান করেন ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ। ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্রকে সরিয়ে দিয়ে সমাজে দুটি নতুন শ্রেণী তৈরি করে- বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত। যেখান থেকে কাল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ এর সূচনা হয় যেটি মার্কসবাদ নামে বেশি পরিচিত।
তখন, অর্থাৎ উনবিংশ শতকে মার্কস ও এঙ্গেলস যুগ্মভাবে এই বিখ্যাত তত্ত্ব প্রদান করেন। তার পরবর্তীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা আরো প্রসারিত হতে থাকে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
1. Cultural Anthropology: Global Forces, Local Lives by Jack David Eller
2. A History of Anthropological Theory by Paul A. Erickson and Liam D. Murphy
3. From Socrates to Sartre by T.Z. Lavine
4. Sophie’s World by Jostein Harder