সিলেটী তরুনীর রাঙামাটি ভ্রমণ
“বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা” বইটি পড়িয়া অনুপ্রাণিত হইয়া আজিকে আমার আপনার একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখিতে বসিয়াছি।
ভিনদেশ বলিতে গেলে কেবল ভারতের আসাম পর্যন্ত যাওয়া হইয়াছে, তথাপি এটিকে ঠিক ভ্রমণ বলিয়া আমার বোধ হয় নাই। কেননা সেই স্থানের (যে স্থানে আমি গিয়াছিলাম) প্রায় সকল কিছু (এমনকি ভাষাও) আমাদের স্বভূম (সিলেট)-এর অনুরূপ। তা সত্ত্বেও কিছুমাত্র বৈচিত্র্য যে বোধ হয় নাই ইহা বলা দুষ্কর। দূরত্বে কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করিলেই মৌখিক ভাষার পার্থক্য হয় কিঞ্চিৎ – ইহা পড়িয়াছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অধ্যয়নের সময়।
প্রকৃতপক্ষে আসাম ও সিলেট ছিল অভিন্ন এলাকা যাহা দেশভাগের মধ্যে দিয়ে আলাদা হইয়া পড়ে। আমি আত্মীয়-পরিজন দ্বারা এতদূর পরিবেষ্টিত রইয়াছিলাম যে পৃথকভাবে সেই স্থানের কোনো দর্শনীয় স্থান বেড়াইবার সুযোগ হইয়া ওঠে নাই। এইখনে অবশ্য উল্লেখ করা জরুরি মনে করিতেছি যে, তখনো মানুষের মধ্যেও যে কতকিছু দেখিবার রহিয়াছে তাহা জানিতাম না।
যাহা হউক, আজিকে আমি যেই দেশীয় (বিদেশযাত্রা নহে) ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখিতে যাইতেছি তাহা প্রায় দুই বৎসর পূর্বের। অতএব স্মৃতির যেই স্থানগুলো ঝাপসা হইয়া আসিয়াছে সেইসকল অপূর্ণই থাকিবে। আমার বয়স অনুপাতে এই কথাটি যদিও মানানসই নহে। আগেকার দিনে, বিশেষ করিয়া ‘পালামৌ’ এর লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাই আমার মনে আসিতেছে; কতকাল পূর্বের স্মৃতিকথা কত না অপরূপ করিয়া মনে রাখিয়া লিখিয়াছেন লেখকেরা। একালে তথ্যপ্রযুক্তি আসিয়া আমাদিগের মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা ও মনোযোগ বহুমাত্রায় কমাইয়া দিয়াছে।
দিনটি ঠিক কবে ছিল আমার মনে নাই, তবে মাসটি সেপ্টেম্বর, ২০২১ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠকর্ম গবেষণার উদ্দেশ্যে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা মিলিয়া রাঙ্গামাটি যাওয়া হইবে স্থির হইলো। তখনোকরোনা মহামারি পুরোপুরি শেষ হয়নাই। বিশ্বব্যাপী মহামারির অবস্থা তখনো সঙ্কটময়, যদিও বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল।
আমরা যেইদিন সিলেট হইতে ট্রেনে করিয়া রওনা দিবো, সেইদিন সকলের পূর্বেই আমি স্টেশনে পৌঁছাইয়া যাই। স্টেশন মাস্টারের সহিত কথা বলিয়া ট্রেন যেন পাঁচ মিনিট বিলম্ব করে আমাদের অন্য সকলের আসিবার জন্য, তাহার অনুরোধ করিতেছিলাম বারংবার। অবশেষে ট্রেন অপেক্ষা করাইতে হয় নাই। ট্রেন ছাড়িবার কয়েক মিনিট পূর্বে সকলেই আসিয়া পৌঁছায় এবং আমরা ট্রেনে ওঠা মাত্রই ট্রেন ছাড়িয়া দেয়।
অতঃপর যেমনটা হইয়া থাকে এরূপ ভ্রমণে, সকলে মিলিয়া গান, হাসিঠাট্টা করিয়া পরদিন পৌঁছাই চট্টগ্রামে। সেইখানে একটি রেস্তোরাঁয় নাস্তা সারিয়া বাসে করিয়া রাঙ্গামাটি রওনা হলাম। রাঙামাটির কাছাকাছি আসিতেই রাস্তাগুলো অত্যন্ত আঁকাবাঁকা ও ভীষণ উঁচু-নিচু হইয়া আসিয়াছিল। পাশ দিয়ে বেশ কতক পাহাড় শ্রেণি দেখিতে পাইতেছিলাম। অনেক বড় না হইলেও সেগুলো আমাদের অঞ্চলের টিলার চাইতে বেশ বড়। আমরা সিলেটবাসীরা অবশ্য মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়গুলো দেখিয়া অভ্যস্ত, তাই বোধ করি অন্যান্য সমতলবাসীদের নিকট সেই পাহাড়গুলি যেরূপ বিশাল দেখাইবার কথা আমাদের কাছে তাহা কিঞ্চিৎ কমই বোধ হইল।
এই রাস্তাগুলির গড়ন এমন যে যাহারা সচরাচর বাস ভ্রমণে বমি করেননা তাহারাও বমি করিলেন। আমার এবং আরোও গুটিকয়েকজনের ভাগ্যক্রমে এহেন দশা হয় নাই। সারা বাস যদি বমনকার্যে রত হইয়া পড়িত তাহা হইলে কীরূপ অবস্থা দাঁড়াইত ভাবা যায় না।
শেষমেশ বৈকালের আগেই আমরা পৌঁছাইয়া গেলাম পূর্ব হইতে ঠিক করিয়া রাখা হোটেলে। হোটেলে ব্যাগ-পত্র রাখিয়াই বাহির হইলাম আমরা। তখনো জানিতাম না কোথায় যাইতেছি। নৌকায় উঠিলাম সকলের সাথে। সহসা কাপ্তাই হ্রদ দেখিয়া মন অতিশয় আনন্দিত হইলো। কাপ্তাইয়ে প্রথমবার, উপরন্তু দীর্ঘদিন (প্রায় দেড় বছর) গৃহে আবদ্ধ থাকিয়া দেহমন যেন হাফ ছাড়িল। ইতঃপূর্বে আমি সিলেট থেকে এত দূরে যাই নাই, তদুপরি সবান্ধবে! নব্য তারুণ্যের এই সময়ে ইহা যে কত পুলক সঞ্চার করে তাহার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
দেখিতে দেখিতে হ্রদের মধ্যে খানিকটা স্থলভাগে আসিয়া পড়িলাম, সেইখানটাই যে আমাদের গন্তব্য ছিল তখন বুঝিলাম। ঐটি ছিল একটি রেস্তোরাঁ, পরে জানিয়াছি ঐটি নাকি রাঙ্গামাটির মধ্যে পাঁচতারকা (অতি উচ্চতর অর্থে) মানের রেস্তোরাঁ। খাবার অতিশয় দামি হওয়ায় আমরা কেবল মসুর ডাল আর মাছের ঝুরিভাজা দিয়া খাওয়া সারিলাম। জায়গাটি বেশ সাজানো-গোছানো, পরিবেশবান্ধব সকল জিনিসপত্র দিয়ে। মানুষ এইখানে যে প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়ার জন্যেই আসে এবং তাহার সমস্ত বিধিব্যবস্থা যে সুণিপুণভাবে পুঁজিবাদের মন্ত্রেই সাজানো হইয়াছে তাহা বোঝা গেল। বোধ করি দাম কিছু কমই ছিল, আরোও বেশি হইলেও পারতো, বড়লোকেরা তাহাতে দ্বিধা করিতেন না। হয়তো এখন দাম বাড়িয়াছে বহুগুণ।
সেই স্থানে বিস্তর ছবি উঠানো শেষে আরোও দুটি দর্শনীয় স্থান দেখা হইলো, সকল স্থানেই নৌকায় করে যাইতে হইয়াছে। ঝুলন্ত ব্রিজের পাশের হাট বসিয়াছিল, সেইসব বাহারী পাহাড়ি জিনিস দেখিয়া এবং কিনিয়া আমরা দেরি করিয়া ফেলিলাম।
সন্ধ্যায় ফিরিয়া নিজেদের সুপারভাইজারদের সহিত বসিয়া গবেষণার বিষয় নির্ধারণ, খাওয়া-দাওয়া এসবেই কাটিল। বিশেষত এই সময়টির বিশেষ স্মৃতি আমার মনে নাই, তাই নিতান্ত সাদামাটা মনে হইতেছে, হয়তোবা তখন কিছুই করি নাই।
পরদিন সকালে আমার জীবনের একটা নূতন দিকের শুরু। ইহার পূর্বে আমি জানিতাম না মানুষের বাড়ি বাড়ি যাইয়া কী করিয়া গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করিতে হয়। এটি আমাদের প্রায় সকলের জন্যই নূতন অভিজ্ঞতা, তাই শিক্ষকগণ সাথে গেলেন। আমাদের দলে আমি একা একজন মেয়ে, আর বাকি সকলে ছিল ছেলে। তবে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আমাদের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা ছিলেন। প্রথমদিন ম্যামই সকল প্রশ্ন করিলেন।
তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার একটি রাস্তায় আমরা হাঁটিতেছিলাম, নির্দিষ্ট কোন বাসা ঠিক করা নাই, কোথায় যাইতেছি জানি না। শুধুমাত্র কমিউনিটি ঠিক করিয়া যেকোনো একজনের বাসায় ঢুকিয়া পড়া। ম্যাডাম একটা টিলার উপরের বাসায় লইয়া গেলেন আমাদের। গৃহকর্তা ছিলেন একজন বেতার কর্মী, তিনি আমাদের সাদরে ঘরের ভিতর নিয়া বসাইলেন। আমাদের সকলেই একেবারে চুপ। ম্যাডামের সাথে যাইয়া বোকার মত বসিয়া রইলাম। ম্যাডাম কথা বলিলেন তাদের সাথে, কেন আমরা আসিয়াছি সেইসব বলিলেন। তাহাদের নিকট হইতে আমাদের গবেষণা সংক্রান্ত তথ্যও ম্যাডাম-ই সংগ্রহ করিলেন। আমরা কেবল লিখিলাম সেসব।
তাহারা আমাদেরকে শরবত দিয়া আপ্যায়ন করিলেন। আবার আসিবার জন্যেও বলিলেন। সেই গৃহটি ছিল একটি টিলার উপর। একটা টিলার উপর একখানা গৃহস্থালি, পুরোপুরি মাটি দিয়ে বানানো একটি ঘর। সামনে বেশ খানিকটা ওঠান, বাঙালিদের চাইতে আলাদা কিছুই মনে হইলো না। যাহা আলাদা তাহা হইলো সেখানের হালকা বসতি, এক বাড়ি হইতে অপর বাড়ি বেশ দূরে। তবে এর ব্যতিক্রমও রহিয়াছে, একটু কম আয়ের মানুষদের ঘরবাড়ি আবার খানিকটা ঘিঞ্জি ছিল অন্যদের তুলনায়।
সেই বাড়ি হইতে নামিয়া হাঁটার পথে আরেকজনের সহিত দেখা হইলো, তিনি আমাদেরকে পরেরদিন তাহার বাড়িতে যাইতে বলিলেন তথ্য সংগ্রহের জন্য। ঐ শান্ত দুপুরে আমরা দাঁড়াইয়াছিলাম শহর থেকে দূরে এক মেঠো রাস্তার মধ্যিখানে, যার একপাশে টিলা, আরেক পাশে মাঠের মধ্যে সামান্য সবজির আবাদ, সাথে অসংখ্য পাখির কলকাকলি। আমরা তখন টিলার ওঠানামা ও পথের হাঁটার কারণে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। তাছাড়া দুপুরবেলা লোকেদের খাওয়ার সময়ে অনাহুতের মত যাওয়া অসুন্দর দেখায় বলিয়া আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আশেপাশে খাবারের যদি একটা বন্দোবস্ত করা যায় তার সন্ধান করবার।
মূল রাস্তা ধরিয়া অনেকখানি হাঁটিয়া রাস্তার পাশে এমন দুইটি ঝুপড়ি দোকান পাইয়াও গেলাম খুঁজতে খুঁজতে যেখানে ভাত-তরকারি পাওয়া যায়। আমরা ভাত খাইলাম এক ধরনের পাঁচমিশালি সবজি (কিছু পাহাড়ি সবজি ছিল তাতে) ও মুচমুচে চাপিলা মাছের ভাজি দিয়ে। সাথে ডাল ছিল কিনা আমি মনে করিতে পারিতেছি না। যেহেতু আমরা এই সবজিগুলো খাইতে অভ্যস্ত না এবং রান্নার ধরনও ভিন্ন, তাই খাইতে মোটেই ভালো লাগিল না। মাছগুলো কোনোভাবে খাইলাম।
অতঃপর পুনরায় হাঁটা। তখন আমরা গাড়ি দিয়া একটু দূরে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম সেখানে অন্য একটি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া আছে জানিয়া। তবে পাড়ায় আর আমাদের যাওয়া হয় নাই। একটি উঁচু রাস্তার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বেশ কতজন মানুষের জমায়েত দেখিয়া আমরাও সেখানেই বসিলাম। তাহাদের সাথে কথা বলিয়া তথ্য সংগ্রহের কাজ ঐদিনের মত শেষ হইল। সেই পড়ন্ত বিকাল বেলায় রাস্তাটি থেকে কাপ্তাইয়ের শান্ত-স্নিগ্ধ দৃশ্য দেখা যাইতেছিল। সেই চায়ের দোকানেই আমার প্রথমবারের মত তেঁতুল চা খাওয়া হয় যা পরবর্তীতে আমার প্রিয় হইয়া ওঠে।
সেখান হইতে আমরা চলে আসি আসামবস্তির বাজারে। সেখানে ব্যাঙ বিক্রি হইতেছিল। বাজারে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করিয়াছিলাম আমরা কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। তবে কেনা হয় নাই কিছুই।
এরপর দিন বেশ প্রাতেই আমরা বাহির হইয়া পড়ি, সেইদিন আর ম্যাডাম যান নাই আমাদের সাথে। আমাদের দলের একজনের কয়জন পরিচিত স্থানীয় সহপাঠীদেরকে (তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সমবয়সী শিক্ষার্থী) সঙ্গে নিয়ে আমরা যাত্রা করি সেই গত দিনের পাড়ায়। ঐদিন আমরা প্রথমেই যাহার বাড়িতে যাই, তিনি ছিলেন কৃষক। এরপর দিনমজুর, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, ধর্মগুরু, কবিরাজ এরকম অনেকের সঙ্গে আমাদের বিস্তর আলাপচারিতার (কাজের জন্য) সুযোগ হয় সেইদিন।
সেদিন দুপুরবেলা আমরা স্থানীয় মন্দিরে একটি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণে খাওয়া-দাওয়াও করি। পাহাড়ি ধরনের সবজি, হালকা সেদ্ধ করিয়া বড় বড় টুকরোর বাঁধাকপি, মাছের ভুনা ও এক বিশেষ চালের (জুমের আঠালো ভাত) পায়েস ছিল সেইদিন পাতে। সেইখানের মানুষজন কিছুটা কৌতূহলী ছিলেন আমাদের নিয়ে। তবে সব থেকে কৌতূহল ছিল বাচ্চাদের। তাদের সাথে পাতার মুকুট নিয়ে বেশ আমোদ-আহ্লাদ করিয়াছিলাম আমি। আমাকে একটা মুকুট বানাইয়া উপহার দিয়াছিল একটি শিশু।
আরও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সেইদিন বাকি ছিল আমাদের জন্য। মন্দির হইতে ফিরিয়া আমরা একজন কবিরাজের বাড়ি যাই। তাঁর বাড়িতে ঢোকামাত্র শুনিতে পাই একটা আর্তনাদ। চারিদিকে সুনসান নীরবতার মধ্যে এইরকম আওয়াজ ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমরা বেশ অনেকজন একসাথে ছিলাম বলিয়াই বোধ করি ভয়টাও আনন্দের ছিল। কবিরাজের বাড়িটি ছিল দ্বিতলা পাকাবাড়ি। সামনেও সিমেন্টে বাঁধানো। প্রথমে আমরা বাড়ির বাহিরেই অপেক্ষা করি, পরবর্তীতে ভিতরে গিয়াছিলাম। ভিতরে যাইয়া জানিতে পারিলাম দুইতলায় একজন পাগলের চিকিৎসা করিতেছিলেন কবিরাজ মহাশয়।
আমরা কাঠ দিয়ে ভাস্কর্য বানানো হয় এরকম একটি দোকানও দেখিয়াছিলাম। রাস্তায় অনেক বাড়িঘরও দেখিয়াছি। পথিমধ্যের বৌদ্ধ মন্দির হইতে তেঁতুল কুড়াইয়া খাইয়াছিলাম।
পরবর্তীতে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি অপূর্ব সুন্দর নানারকমের ফুল ও অর্কিডবেস্টিত রেস্তোরাঁয় আমরা নাস্তা করি। তার আগে অবশ্য আরোও একটি রিসোর্টে বেড়াইয়া আসি এবং আমাদের সেই স্থানীয় বন্ধুদের গান শুনি। সেই দিনটি, আমার ধারণা আমাদের সকলেরই জীবনের একটি অন্যতম ভালো দিন ছিল। আমাদের সেই বন্ধুরা আমাদের আগামী বিজুর আন্তরিক নিমন্ত্রণ জানাইয়াছিল। বিশেষ করে বিজুর আগের দিনের ফুলবিজুতে কত আনন্দ হয় তার আখ্যান শুনিয়া আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মে তা দেখার।
পরদিন রাঙামাটির আরোও বৌদ্ধ বিহার ও রাজবাড়ী ইত্যাদি জায়গায় বেড়াইয়াছি। কিন্তু মানুষের সাথে মিশিয়া যে অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করিয়াছিলাম তার কাছে তাহা যেন কিছুই না। তবে আমার একটি বিশেষ জিনিসের কথা উল্লেখ না করিলেই নয়, একটি ওড়না। সেইদিন একটি বিহারের সামনে কয়েকজন হাতে বোনা ওড়না বিক্রির জন্য নিয়া বসিয়াছিলেন। তার মধ্যে একটি ভীষণ পছন্দ হইয়াছিল আমার। আমি দামাদামি করিয়া দামে না হওয়ায় না কিনিয়াই ফিরিয়া যাইতেছিলাম। ঠিক নৌকায় উঠে যাওয়ার সময় আবার কী মনে হইলো, ফিরিয়া গিয়া সেই ওড়নাটি কিনিয়া লইলাম। আমার সেই অতিশয় পছন্দের বস্তুটি রাঙামাটি ফেলিয়া আসিলে আমার বড়ই আফসোস থাকিয়া যাইতো মনে মনে।
সেইদিনই বিকালে আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়া পরদিন সকালে সিলেট পৌঁছাইয়াছিলাম। ট্রেন জার্নি ও সেইসাথে এইকয়দিনের টানা নৌভ্রমণে আমাদের শরীরের দুলুনিভাব যেন কাটিতে চাহে না তখন।
রাঙ্গামাটি মনটা রাঙ্গাইয়া দিয়াছিল সকলেরই। আমার মনে হইতেছিল কয়দিনেই যেন কতটা আপন হইয়া মিশিয়া গিয়াছে রাঙ্গামাটি শহরটা, যেন কতদিন ধরিয়াই না আমি থাকি সেথায়! আমি আবারও যাইতে চাই, থাকিতে চাই সেথায়। শুধু বাণিজ্যিক এলাকায় না ঘুরিয়া যেখানে কেহ বেড়াইবার জন্য সচরাচর হয়ত যায় না, সেইখানেও যাইতে চাই। মানুষের সহিত মিলিয়া মিশিয়া প্রাণে আনন্দ ও ভালোবাসা জাগাইবার জন্য, সেই অমূল্য পাতারমুকুটে ভূষিত হইবার জন্য আমি আবারও যাইতে চাই। ভ্রমণ আমার নিকট তখন হইতেই প্রকৃতি ও মানুষকে জানার মিলিত প্রয়াস।