প্রসঙ্গ ধর্ম: একটি নৃবৈজ্ঞানিক আলোচনা

নৃবিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে মানবসমাজের বৈচিত্রের অধ্যয়ন। মানুষের বৈচিত্র বুঝতে হলে প্রতিটি সমাজের সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে। নৃবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন গবেষণার মাধ্যমে কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের সংস্কৃতির প্রকৃত অর্থ তুলে আনতে। সেই লক্ষ্যে নৃবিজ্ঞানীরা আদিকাল হতে মানুষের সমাজ এবং সংস্কৃতি নিয়ে অধ্যয়ন করে যাচ্ছেন। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে ধর্ম, কেননা ধর্ম আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের উপর ধর্মের প্রভাব ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। ধর্মের প্রভাব যেমন বহুমাত্রিক ঠিক তেমনি ধর্ম বিষয়টিও অনেক বেশি জটিল। তাই একে সংজ্ঞায়িত করাও সহজ নয়। 

সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মত ধর্মেরও কোন পরম সংজ্ঞা হয় না। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তাত্ত্বিক ঘরানা হতে ধর্মের সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাস ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে সকল ধরনের বিশ্বাস ‘ধর্ম’ হিসেবে গণ্য হবে না। 

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম এর মতে ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সঙ্গে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় তৈরি করে। অর্থাৎ ডুর্খেইম এর মতে ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে এমন একটি বিশেষ বিশ্বাস ব্যবস্থা যা শুধুমাত্র পবিত্র বস্তুর সঙ্গে যুক্ত। 

নৃবিজ্ঞানে ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধর্মের অর্থ, ধর্মের উৎপত্তি, ধর্মের বিবর্তন, বিভিন্ন সমাজের বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদিকে আলোকপাত করা হয়। এছাড়াও এই বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিশ্বাস ব্যবস্থা যেমন ‘ডাকিনীবিদ্যা’, ‘যাদু-টোনা’, ‘শামান’, ‘বশীকরণ’, ‘মিথ’ ইত্যাদি বিষয়বস্তুকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। কেননা এই বিষয়গুলো কোন কোন সমাজে ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। 

নৃবিজ্ঞানের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে বৈচিত্রের অনুসন্ধান। তাই নৃবিজ্ঞান কখনো ধর্ম ‘সত্য’ কি ‘মিথ্যা’ তা যাচাই করে না, বরং এর কাজ হচ্ছে ধর্মের স্বরূপ বিশ্লেষণ। তাছাড়া সমাজের অন্যান্য সংগঠনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক কিরূপ এটিও নৃবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। 

নৃবিজ্ঞানের আলোকে ধর্ম

পৃথিবীর প্রত্যেকটি সমাজে ধর্মের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যদিও ধর্মের রূপ গুলো ভিন্ন। আবার সময়ের সাথে অনেক ধর্ম পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এত পরিবর্তন এর মাঝেও অত্যাধুনিক সমাজে এখনো ধর্ম কিভাবে টিকে আছে নৃবিজ্ঞানীরা তা অনুসন্ধান করেন। বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানীরা ধর্মকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ই.বি. টাইলর, আর.আর. মারেট, জেমস ফ্রেজার, এমিল ডুর্খেইম, কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ইভান্স প্রিচার্ড, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ, তালাল আসাদ প্রমুখ। নিম্নে সংক্ষেপে তাঁদের তত্ত্ব উপস্থাপন করা হলো:

ই.বি. টাইলর (১৮৩২-১৯১৭): ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের জনক ই.বি. টাইলর ধর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘animism’ বা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ এর ধারণা পেশ করেন। তাঁর মতে স্বপ্নের ধারণা এবং মৃত্যুর চেতনা হতে মানুষ আত্মা বা প্রেতাত্মার ধারণা লাভ করে। যেহেতু ঘুমের মাঝে স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করতে পারে সেখান থেকে আদিম মানুষের ধারণা হয় আত্মা সম্পর্কে যা ঘুমের সময় দেহের বাইরে যেতে পারে। একইভাবে মৃত্যুকে তারা আত্মার চিরবিদায় হিসেবে ব্যাখ্যা করে। আত্মা বা প্রেতাত্মার এই ধারণা তারা অন্যান্য প্রাণী এমনকি জড়বস্তুর উপরও আরোপ করে। টাইলর এর মতে এর থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। তিনি ধর্মের বিবর্তন এর একটি রূপরেখা দাঁড় করান। তাঁর মতে ধর্ম বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে বিকশিত হয়ে সর্বপ্রাণবাদ হতে একেশ্বরবাদে উপনীত হয়। তাঁর ধর্মের বিবর্তনের ধাপ গুলো নিচে দেয়া হল – 

১. সর্বপ্রাণবাদ 

২. পূর্বপুরুষের পূজা 

৩. বস্তু ভক্তিবাদ 

৪. প্রকৃতি পূজা বা বহুঈশ্বরবাদ 

৫. একেশ্বরবাদ 

টাইলর মনে করেন ধর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিক বস্তুর উপর বিশ্বাস এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা যেমন জন্ম-মৃত্যু, পরকাল ইত্যাদি বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই বিশ্বাসের জন্ম হয়।

আর.আর. মারেট: অপর একজন ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী আর.আর. মারেট টাইলরের ধারণাকে অস্বীকার করেন। তিনি মনে করেন সর্বপ্রাণবাদ এর পূর্বে আরেকটি ধারণা মানুষের মধ্যে ছিল তিনি যার নাম দেন ‘animatism’। 

Animatism বলতে তিনি বুঝান একটি অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে যার থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয়। এই অতিপ্রাকৃত শক্তি কে তিনি বিদ্যুতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পলিনেশিয়া এবং মেলানেশিয়ার ধর্ম বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান আদিম মানুষ আত্মার বাইরেও কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারণা নিতে পারে। 

পলিনেশিয়া এবং মেলানেশিয়ায় এক ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর বিশ্বাস করা হয় যাকে বলা হয় ‘মানা’। মানা বলতে বুঝায় চিন্তাশক্তি, আবেগ, স্মৃতিশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ইত্যাদির সমষ্টি অর্থাৎ মানসিক শক্তি। এই শক্তি একজনের কাছ থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো অন্যজনের কাছে প্রেরণ করা যায়। মারেটের মতে আত্মা বা প্রেতাত্মা থেকে নয় বরং এই মানা থেকেই ধর্মের উৎপত্তি।

জেমস ফ্রেজার: জেমস ফ্রেজার তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Golden bough’ (১৮৯০) – তে ধর্মকে মানব চিন্তার বিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। মানব চিন্তার ধাপগুলোকে তিনি তিনটি ভাগে ভাগ করেন- জাদু, ধর্ম এবং বিজ্ঞান। 

তার দৃষ্টিতে ধর্মের পূর্বতন অবস্থা ছিল যাদুবিদ্যা এবং ধর্মের পরবর্তীতে আসে বিজ্ঞান। তিনি অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী উপজাতির জীবনযাপন পদ্ধতির সাহায্যে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তাদের কোন ধর্ম ছিল না, ছিল কেবলমাত্র জাদুবিদ্যা। এর থেকে তিনি এই ধারণায় উপনীত হন যে জাদুবিদ্যা ধর্মের পূর্বে আবির্ভূত হয়। 

তিনি মনে করেন প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যেই জাদু এবং পরবর্তীতে বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। জাদু কে তিনি ‘ছদ্ম বিজ্ঞান’ নামে আখ্যায়িত করেন। জাদু ও বিজ্ঞান এর মধ্যে তিনি সাদৃশ্য দেখতে পান। জাদু ও বিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাখ্যা করা। অপরদিকে ধর্মকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন মানুষের চাইতে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন শক্তি হিসাবে যেটিকে মানুষ প্রসন্ন করতে কিংবা বশ করতে চায়।

এমিল ডুর্খেইম: ডুর্খেইম তার ‘The Elementary Forms of Religious Life’ (১৯১৫) গ্রন্থে ধর্ম সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি ধর্মকে টাইলরের মতো আধ্যাত্মিকতা নয় বরং পবিত্রতার ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করেন। 

তিনি বলেন ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সঙ্গে যুক্ত বিশ্বাস। তার মতে এই বিশ্বাস সামাজিক সংহতি তৈরি করে। টাইলস এবং ফিচারের মত তিনিও একজন বিবর্তনবাদী। টোটেমবাদ কে তিনি আদিমতম ধর্ম হিসেবে আখ্যা দেন। 

টোটেম হচ্ছে কোন একটি জিনিসের প্রজাতি যেটি একটি গোষ্ঠীকে সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ করে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের জীবন যাপনের পদ্ধতি এবং ধর্ম থেকে তিনি এই ব্যাখ্যা দেন। কোন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট প্রতীক বা টোটেম এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এবং এটিকে ঘিরে তাদের ধর্মীয় জীবন আবর্তিত হয়। তাদের সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং উৎসবে এই টোটেমকে দেখতে পাওয়া যায়। 

ডুর্খেইম মনে করেন এই  টোটেমবাদই হচ্ছে ধর্মের আদিমতম রূপ। তিনি ধর্মকে সামাজিক জীবনের ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি হিসেবে দেখেন। তিনি মনে করেন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো সামাজিক ঐক্য সংহতি পাকাপোক্তকরণের ব্যবস্থা করে থাকে।

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস: বিজ্ঞানী কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ধর্মের উৎস কিংবা আদিমতম রূপ সম্পর্কে ততটা উৎসাহী ছিলেন না। বরং তাঁরা ধর্ম কীভাবে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেদিকে আলোকপাত করেন। তাঁরা ধর্মকে শ্রেণিসংগ্রামের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা মনে করেন ধর্ম পরজগতের সুখ-শান্তির আশা দেখিয়ে নিপীড়িত জনগণকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা থেকে  বিরত রাখে এবং এভাবে বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো এবং শাসন ব্যবস্থাকে বলবৎ রাখে। মার্কস ধর্মকে নিপীড়িত জনগণের আফিম হিসেবে আখ্যা দেন। তাঁরা ধর্মকে অধিপতি শ্রেণীর মতাদর্শের প্রতিফলন হিসেবে দেখেন।

ইভান্স প্রিচার্ড: ইভান্স প্রিচার্ড দক্ষিণ সুদানের আজান্দে এবং নুয়ের সমাজে মাঠ গবেষণা কালীন তাদের দৈনন্দিন জীবনে ডাকিনীবিদ্যা, যাদু-টোনা ইত্যাদির প্রভাব লক্ষ্য করেন। ডাকিনীবিদ্যা ও জাদু-টোনা  ঐ অঞ্চলে ধর্ম হিসেবে অনুশীলন করা হয়। প্রিচার্ড এর উপর কিছু বই লিখেন। তন্মধ্যে Witchcraft, Oracles, and Magic among the Azande (১৯৩৭) এবং Nuer Religion (১৯৫৬) অন্যতম।

ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ: ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের পূর্বে বিভিন্ন তাত্ত্বিকেরা ধর্মের যে সকল সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন তাতে বিশ্বের সকল ধর্মের নির্যাস পরিপূর্ণভাবে আসে না। তাঁর প্রদত্ত ধর্মের সংজ্ঞায় এমন একটি পরিপূর্ণ এবং সমন্বিত রূপ প্রকাশিত হয় যে এখন পর্যন্ত একেই সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসেবে ধরা হয়। গিয়ার্টজ তাঁর ‘Interpretation of Cultures’ গ্রন্থে নিম্নোক্ত সংজ্ঞাটি প্রদান করেন। 

‘A religion is a system of symbols which acts to establish powerful, pervasive and long lasting moods and motivations in men by formulating conceptions of a general order of existence and clothing these conceptions with such an aura of factuality that the moods and motivations seem uniquely realistic.’ [গিয়ার্টজ ১৯৭৩, ৯০]

গিয়ার্টজ তাঁর সংজ্ঞাকে ৫ টি ভাগে ভাগ করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলছেন ধর্ম হচ্ছে একটি প্রতীক ব্যবস্থা। প্রতীক বলতে যেমন আমরা বুঝি কোন বিমূর্ত ধারণার মূর্তমান অবস্থা। ঠিক একই ভাবে ধর্মীয় প্রতীক গুলো যেমন, ক্রুশ, এটি একটি বিমূর্ত ধারণা কে আকৃতি প্রদান করছে। তার সংজ্ঞার পরবর্তী ধাপে তিনি ব্যাখ্যা করেন ধর্ম কিভাবে মানুষের মধ্যে একটি শক্তিশালী, ব্যাপৃত এবং দীর্ঘমেয়াদী মেজাজ এবং উদ্দীপনা তৈরী করে। 

তিনি বলেন ধর্ম মানুষের অস্তিত্বের সাধারণ বিন্যাস সম্পর্কে এমন কিছু ধারনা প্রদান করে এবং সে সকল ধারণাকে এমনভাবে সত্যের মোড়কে পেশ করে যে সেগুলো একচ্ছত্রভাবে সত্যি বলে মনে হয়। তিনি আরো বলেন মানুষ তার কল্পনাশক্তি সামাল দিতে পারে না অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এমন কোন কিছু মেনে নিতে পারে না। তাই অস্তিত্বের ব্যাখ্যা খুঁজতে তারা ধর্মের দ্বারস্থ হয়। তাঁর এই সংজ্ঞা থেকে ধর্ম কি এবং কিভাবে ‘ধর্ম’ নামক প্রত্যয়টি যুগ যুগ ধরে সকল সমাজে টিকে আছে তার একটি যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।

তালাল আসাদ: ধর্ম নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় তালাল আসাদ সবচেয়ে আলোচিত নৃবিজ্ঞানী। তিনি ধর্মকে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘Anthropology and The colonial Encounter’ বইটি পশ্চিমা নৃবৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া ধর্মসংক্রান্ত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত বই হচ্ছে ‘Genealogies of Religion: Discipline and Reasons of Power in Christianity and Islam’ (১৯৯৩)। তিনি ধর্ম সম্পর্কিত আলোচনায় তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে আসেন, সেগুলো হচ্ছে- 

১. পশ্চিমা ক্ষমতা ও হেজেমনি।

২. বর্তমান বিশ্বের সাপেক্ষে সার্বজনীনতার ধারণায় গিয়ার্টজের সংজ্ঞার সমালোচনা।

৩. ধর্ম ও ক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক।

তিনি দেখান কিভাবে পশ্চিমা সমাজ বিশ্বের সকল সমাজের জন্য পশ্চিম এর আলোকে স্বাভাবিকতার মানদন্ড  নির্মাণ করে দিচ্ছে যেন সকল সামাজ একই সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করে। এছাড়া তিনি গিয়ার্টজের সংজ্ঞাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেন। তিনি বলেন যদি ধর্মকে একটি প্রতীক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয় তাহলে এই প্রশ্ন চলে আসে যে এই প্রতীক কোথা থেকে আসলো এবং এটি কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আবার একই প্রতীকের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রকম অর্থ থাকতে পারে। আসাদের মতে ধর্মের কোন সার্বজনীন সংজ্ঞা থাকতে পারে না কেননা ধর্ম একটি ইতিহাস নির্দিষ্ট এবং স্থাননির্দিষ্ট বিষয়। তিনি মনে করেন ধর্মের বর্তমান ব্যক্তিক প্রতিচ্ছবি নির্মাণ এবং সেক্যুলারিজমের ধারণা অনেক বেশি রাজনৈতিক এবং এর সাথে ক্ষমতা এবং পশ্চিমা হেজেমনির সম্পর্ক রয়েছে। 

ধর্ম একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয় হিসেবেই সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা একে অধ্যয়ন করেন।  যদিও নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মকে অধ্যয়ন করা কিছুটা সমস্যাপূর্ণ। নৃবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক জ্যাক ডেভিড অ্যালার তার ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘Cultural Anthropology: Global forces local lives’ বইটিতে এ বিষয়ে আলোকপাত করেন। 

তিনি বলেন, যেহেতু নৃবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘বিভিন্ন সংস্কৃতির আলোকে’ (cross culturally), ‘সার্বিকভাবে’ (holistic), এবং ‘আপেক্ষিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে'(cultural relativistic) কোন কিছুকে ব্যাখ্যা করা, ধর্মকেও সেভাবেই দেখতে হবে। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে এই ভাবে ব্যাখ্যা করা পর্যবেক্ষকের পক্ষে কষ্টসাপেক্ষ। 

সংস্কৃতির অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আসে না তা হলো সত্য এবং মিথ্যার ধারণা, যেমন তিনি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন, কোন সমাজের ভাষা ‘সত্য’ অথবা ‘মিথ্যা’ এই প্রশ্ন কখনোই আসে না। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রকট আকারে দেখা যায়। পর্যবেক্ষক এবং যিনি পর্যবেক্ষিত হচ্ছেন উভয়ের ক্ষেত্রে ধর্মকে যুঝতে (deal with) হয় সত্যতার বিষয় নিয়ে। তিনি এই বিষয়ে জেমস ফ্রেজার, ইভানস প্রিচার্ড, হেরোডোটাস প্রমুখের উদাহরণ নিয়ে দেখান। ধর্ম অতীব সংবেদনশীল একটি ইস্যু এবং একই সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

শুধুমাত্র আধ্যাত্বিক ভাবেই নয় বরং সমাজের অন্যান্য দিক যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে যে কারণে এটিকে কখনো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই নৃবিজ্ঞানে এর অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরী।

গ্রন্থ সহায়িকা 

Eller, Jack David.2009. Cultural Anthropology: Global forces, local lives. UK: Routledge. 

Ericson, Paul A., Murphy Liam D. 2013. A History of Anthropological Theory. Toronto: University of Toronto Press.

Geertz, Clifford. 1973. The Interpretation of Cultures. New York: Basic Books.

আহমেদ, রেহনুমা ও চৌধুরী, মানস. ২০০৩. নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠঃ সমাজ ও সংস্কৃতি. ঢাকাঃ একুশে পাব্লিকেশন্স লি.।